লবণাক্ত মৃত্তিকা ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফসলের চাষ নিবিড়করণ
ড. দেবাশীষ সরকার১ ড. নির্মল চন্দ্র শীল২
মৃত্তিকা সবচেয়ে মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ যার উপর দেশের খাদ্য নিশ্চয়তা, দারিদ্র্যবিমোচন, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ সর্বোপরি টেকসই কৃষি অর্জনের মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ নির্ভরশীল। দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি ও জীবসত্তার বেঁচে থাকার প্রধান নিয়ামক হচ্ছে মাটি। মাটির গুরুত্ব আমাদের অস্তিত্ব, চেতনা ও অপরিহার্য গন্তব্যের সোপানে বিনির্মিত। এ ধরনের মহামূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদের সুষ্টু ও বিজ্ঞানভিত্তিক ব্যবহার সুনিশ্চিত করা একান্ত জরুরি। আর সে কারণে বিশ্ব মৃত্তিকা দিবস উদ্যাপন মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করছে।
বাস্তবে প্রতি বছর ০.৭৩% হারে কৃষি জমি অকৃষি খাতে চলে যাচ্ছে। বৈশ্বিক ঊষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত প্রভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অতিবৃষ্টিজনিত প্লাবন ও অনাবৃষ্টিজনিত খরা, অত্যধিক গরম, অত্যাধিক শীতের কবল সেইসাথে সমুদ্রের পানির উচ্চতা বৃদ্ধিজনিত কারণে মাটিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাওয়াজনিত অভিঘাতে বর্তমান ও ভবিষ্যতের কৃষি অতিশয় চ্যালেঞ্জে পর্যবসিত। এক গবেষণা সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, লবণাক্ততা ও অম্লতা বৃদ্ধিজনিত কারণে বছরপ্রতি ফসলের উৎপাদন যথাক্রমে ৪৪.২ ও ৯.০ লক্ষ টন হ্রাস পায়। জাতিসংঘ কর্তৃক প্রণীত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট ১৫.৩-এ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ভূমি অবক্ষয় শূন্যের কোঠায় পৌঁছানোর টার্গেট নির্ধারিত হয়েছে। তা ছাড়া আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ন্যূনতম ৫৫% বজায় রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
মাত্রাতিরিক্ত সোডিয়াম, ক্লোরাইড, সালফেট, বাইকার্বোনেট জাতীয় লবণ ও তাদের আয়নের উপস্থিতি মাটি ও পানিকে লবণাক্ত করে থাকে, যা উদ্ভিদের বৃদ্ধি, বিকাশ, ফুল-ফল ধারণ ও ফলনের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করে। নাব্যতা হ্রাস পাওয়া, শুষ্ক আবহাওয়া এবং বৃষ্টিপাতের সময় ও গতিধারায় পরিবর্তন, সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, শুষ্ক মৌসুমে মাটির পানি বাষ্পীভবনের ফলে মৃত্তিকা দ্রবণের লবণ মাটির উপরে চলে আসা, সমুদ্রের লোনাপানি আবদ্ধ করে চিংড়ি চাষ, অপরিকল্পিত ও ত্রুটিপূর্ণ স্লুইসগেট ও পোল্ডার ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি বিষয় মৃত্তিকার লবণাক্ততা বৃদ্ধির প্রধান কারণ।
বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলের ২.৮৬ মিলিয়ন হেক্টর জমির (দেশের মোট ভূমির প্রায় ৩০%) মধ্যে ১.০৬ মিলিয়ন হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার লবণাক্ততা কবলিত হয়ে পড়েছে এবং এর পরিমাণ ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে। সাধারণত লবণাক্ততার মান ৪ ডিএস/মিটার-এর বেশি হলে ফসলের বৃদ্ধি, বিকাশ ও ফলনের ওপর বিরূপ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মাটির লবণাক্ততা ১৬ ডিএস/মিটারের বেশি হলে সেই মাটিতে চাষাবাদ অন্তত দুরূহ হয়ে পড়ে এবং ফসল ফলানো সম্ভব নাও হতে পারে। অপরদিকে সেচের পানির ইসি মান ১ ডিএস/মিটার বা ততোধিক হলে উক্ত পানি লবণাক্ততা কবলিত এবং সেচের কাজে ব্যবহার করলে ফসলহানির সম্ভাবনা থাকে।
লবণাক্ততা কবলিত উদ্ভিদের লক্ষণসমূহ: পাতার শীর্ষভাগ প্রথমে সাদা হয়ে যায় পরবর্তীতে পুড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। গাছের বৃদ্ধি কমে যায় এবং গাছ খর্বাকৃতি হয়ে পড়ে। শাখা প্রশাখা ও কুশি কমে যায়। দানাদার ফসলের শীষ অপুষ্ট হয়। শীষে কিংবা পডে বীজের সংখ্যা কমে যায়। বীজের ওজন হ্রাস পায়। পাতা মোড়ানো রূপ ধারণ করে। পাতায় সাদা সাদা দাগ দেখা যেতে পারে। শিকড়ের বৃদ্ধি কমে যায়। ফুলের সময়কাল পরিবর্তিত হতে পারে। পাতা, পল্লব ও কাণ্ডে সোডিয়াম ও ক্লোরিন বেশি জমা হয়। পটাশিয়াম, ফসফরাস ও জিংক পরিশোষণ কমে যায়।
মাটির লবণাক্ততা প্রতিরোধ করে ফসলের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। খাদ্য ও পুষ্টি চাহিদা নিশ্চিতকরণের জন্য বিএআরআই দেশি-বিদেশি প্রকল্পের সহায়তায় গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে বেশ কিছু লাগসই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। লবণাক্ত মাটিতে ফসল ফলানো দুরূহ হলেও মধ্যম মাত্রার লবণাক্ত (৪-১২ ডিএস/মি) জমিতে গম, ভুট্টা, খেসারি, মুগডাল, ছোলা, তিসি, তিল, সূর্যমুখী, মরিচ, ধনিয়া, টমেটো, বাঁধাকপি, তরমুজ, খিরা, প্রভৃতি ফসল মৃত্তিকা ও ফসল ব্যবস্থাপনার টেকসই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে লাভজনকভাবে চাষাবাদ করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে ফসল ধারা পরিবর্তন, আগাম ফসল বপন রোপণ, আন্তঃফসল, মিশ্রফসল চাষ, মালচিং, ড্রিপ সেচ, উঁচু বেড পদ্ধতি প্রভৃতি প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা আবশ্যক। তা ছাড়া বিভিন্ন ফসলের লবণাক্ততাসহনশীল জাত উদ্ভাবিত হয়েছে যা চাষ করার মাধ্যমে লবণাক্ত অঞ্চলে সাফল্যজনকভাবে ফসল চাষ করা সম্ভব। ফসলের লবণাক্ততা সহনশীল জাত সারণি দ্রষ্টব্য।
উঁচু বেড পদ্ধতি ও অধিক হারে পটাশিয়াম সার প্রয়োগে লবণাক্ত অঞ্চলে হাইব্রিড ভুট্টা উৎপাদন
লবণাক্ত অঞ্চলে (নোয়াখালী, পটুয়াখালী, বরগুনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীর, খুলনা প্রভৃতি) ফসলের নিবিড়তা বৃদ্ধির জন্য ১০-১২ ইঞ্চি উঁচু বেড তৈরি করে প্রচলিত সুপারিশের চেয়ে শতকরা ৫০ ভাগ অধিক পটাশিয়াম প্রয়োগ করে হাইব্রিড ভুট্টা (বারি হাইব্রিড মেইজ-৭) চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৮-১০ টন ফলন পাওয়া সম্ভব। সনাতনী পদ্ধতির ফলনের তুলনায় ৩৫-৪০% অধিক হয়। অধিক হারে পটাশিয়াম সার প্রয়োগ ও বেড উঁচু হওয়ার কারণে গাছের মূলাঞ্চলে ক্ষতিকর সোডিয়ামের কার্যকারিতা কমে যায় ও গাছ কর্তৃক পটাশিয়াম পরিশোষণ বৃদ্ধি পায়। ফলে গাছের জৈবিক ক্রিয়া, পানির প্রবাহ ও অন্যান্য অত্যাবশকীয় পুষ্টি উপাদানের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। বিএআরআই নোয়াখালী (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১৮) ও পটুয়াখালী (কৃষি পরিবেশ অঞ্চল-১৩) অঞ্চলে তিন বছর গবেষণা করে উক্ত প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে।
ফসলের নাম |
জাতের নাম
|
ধান | ব্রি ধান৬৭, ব্রি ধান৪০, ব্রি ধান৫৩, ব্রি ধান৫৫, ব্রি ধান৭৩, বিনা ধান-৮, বিনা ধান-১০ |
গম | বারি গম-২৫, বারি গম-৩৩ |
ভুট্টা |
বারি ভুট্টা-৯, বারি ভুট্টা-১১, বারি ভুট্টা-১৬ |
বার্লি |
বারি বার্লি-৭, বারি বার্লি-৮, বারি বার্লি-৯ |
আলু |
বারি আলু-৭২, বারি আলু-৭৩, বারি আলু-৭৮, বারি আলু-৭৯ |
মিষ্টিআলু |
বারি মিষ্টিআলু-৭, বারি মিষ্টিআলু-৮ |
মুগডাল |
বারি মুগ-৬ |
তিল |
বারি তিল-৪ |
সূর্যমুখী |
বারি সূর্যমুখী-৩ |
সরিষা |
বারি সরিষা-১১, বারি সরিষা-১৬, বিনা সরিষা-৫ |
সয়াবিন |
বারি সয়াবিন-৬ |
টমেটো |
বারি হাইব্রিড টমেটো-৮ (গ্রীষ্মকালীন), বারি টমেটো-১৪, বারি টমেটো-১৫ |
তরমুজ |
বারি তরমুজ-২ |
সারের মাত্রা ও প্রয়োগ পদ্ধতি
মৃত্তিকা পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অঞ্চলভেদে হাইব্রিড ভুট্টা চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ইউরিয়া ৬০০-৬৫০ কেজি, টিএসপি ২৮০-৩৪০ কেজি, এমওপি ২৫০-২৭৫ কেজি, জিপসাম ১৬০-১৮০ কেজি, জিংক সালফেট (মনো হাইড্রেট) ১০-১৫ কেজি এবং বরিক এসিড ৬-৮ কেজি প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া সার সমান তিনভাগ করে এক-তৃতীয়াংশ বীজ গজানোর ৫ দিন পর, এক-তৃতীয়াংশ বীজ বপনের ৩০-৩৫ দিন পর এবং বাকি অংশ বীজ বপনের ৫০-৬০ দিন পর প্রয়োগ করতে হবে। সমুদয় টিএসপি ও জিপসাম এবং দুই তৃতীয়াংশ এমওপি জমি তৈরির শেষ চাষের সময় প্রয়োগ করতে হবে। জিংক সালফেট ও বরিক এসিড একটি প্লাস্টিকের বালতি বা গামলায় ঝুর ঝুরে মটির সাথে মিশ্রিত করে জমি প্রস্তুতের শেষ পর্যায়ে মটিতে ছিটিয়ে প্রয়োগ করতে হবে। বাকি এক- তৃতীয়াংশ এমওপি সার ২য় কিস্তি ইউরিয়া সারের সাথে প্রয়োগ করতে হবে।
ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে লবণাক্ত অঞ্চলে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ
ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে লবণাক্ত অঞ্চলে (সাতক্ষীরা, খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী) সাফল্যজনকভাবে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ করা সম্ভব। ড্রিপ সেচ পদ্ধতির সুবিধা হলো গাছের মূলাঞ্চলে ফোঁটা ফোঁটা আকারে প্রয়োজনীয় সার মিশ্রিত পানির দ্রবণ পড়তে থাকে বিধায় মৃত্তিকার লবণের তীব্রতা হ্রাস পায়। এ পদ্ধতিতে সারের ব্যবহার ৩০-৪০% হ্রাস করা যায়। তা ছাড়া সেচের পানি ৫০% কম প্রয়োজন হয়। এ পদ্ধতিতে টমেটো চাষের জন্য হেক্টরপ্রতি ১৮০-২০০ কেজি ইউরিয়া, ২২৫-২৫০ কেজি টিএসপি, ১২০-১৫০ কেজি এমওপি, ১০০-১২০ কেজি জিপসাম, ৬-৮ কেজি বরিক এসিড, ৩-৬ কেজি জিংক সালফেট এবং ৩-৫ টন জৈবসার প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া এবং এমওপি ছাড়া অন্যান্য সার সুপারিশ অনুযায়ী জমি তৈরির শেষ পর্যায়ে প্রয়োগ করতে হবে। ইউরিয়া এবং এমওপি সার চারা রোপণের ১৫, ৩০, ৪৫ ও ৬০ দিন পর সমান ৪ (চার) ভাগে সেচের পানির সাথে মিশিয়ে ড্রিপ সেচের মাধ্যমে প্রয়োগ করা বিধেয়। ড্রিপ সেচ পদ্ধতিতে চাষ করলে হেক্টর প্রতি ৩০-৩৫ টন গ্রীষ্মকালীন টমেটোর ফলন পাওয়া যায় যা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় ২৫-৩০% বেশি এবং নিট মুনাফা শীতকালীন টমেটোর তুলনায় ২-২.৫ গুণ পাওয়া সম্ভব।
মৃত্তিকা সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়ায় প্রকৃতির হাজার হাজার বছর প্রয়োজন হয়। পরিতাপের বিষয় মানুষের অপরিকল্পিত ও যথেচ্ছ ব্যবহারের ফলে অল্প সময়ের মধ্যে মৃত্তিকা তার নিজস¦ গুণাবলী হারিয়ে অনুর্বর হয়ে পড়ে। খাদ্য উৎপাদন টেকসইকরণ ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য লবণাক্ততা কবলিত উপকূলীয় অঞ্চলসহ প্রতিকূল পরিবেশে ফসল চাষ নিবিড়করণ একান্ত প্রয়োজন। সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য লবণাক্ততাসহ অন্যান্য মাটি সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মৃত্তিকা সম্পদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এখন সময়ের দাবি। আর তাই বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসে আমাদের অঙ্গীকার নিম্নরূপ ছন্দে ব্যক্ত হতে পারেÑ
বিশ্ব মৃত্তিকা দিবসের অঙ্গীকার,
নিশ্চিত করি মৃত্তিকা সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার।
মাটির উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করে,
পুষ্টিসমৃদ্ধ নিরাপদ খাদ্যে দেই দেশ ভরে।
লেখক : ১মহাপরিচালক, বিএআরআই,২মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা, পরিকল্পনা ও মূল্যায়ন উইং, গাজীপুর, মোবাইল : ০১৭১৮২০১৪৯৯, ই-মেইল : nirmal_shil@yahoo.com